জগন্নাথদেব মাসির বাড়ি থেকে ফিরে সিংহ দুয়ার দিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবে আর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন মা লক্ষ্মী। মারাত্মক অভিমান। কোন অনুনয় বিনয়তেই কাজে এলো না। বলরাম, সুভদ্রা ততক্ষণে ভিতরে চলে গেছেন। শ্রীদেবী লক্ষ্মী দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। জগন্নাথ বাইরেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। সটান মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেও লক্ষ্মী মাও কী ভালো থাকেন? সেযুগেও কী দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলতো লক্ষ্মীরা?

লক্ষ্মী দেবীর রাগ- অভিমানের সঙ্গত কারণ রয়েছে। জগন্নাথ দেবের সঙ্গে দেখা করতে তিনি গুণ্ডিচা মন্দির অবধিও গেছিলেন। কিন্তু জগন্নাথ যে তখন মত্ত, সীমাহীন উচ্ছ্বাসে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। সেই যে লক্ষ্মীর হইল অন্তরে ব্যথা, সে ঘা সহজে শোকাবার নয়। এ দৃশ্য ফিরে ফিরে আসে বলেই কবিদের লিখতে হয়, “রাধার কি হৈল অন্তরের ব্যাথা। বসিয়া বিরলে, থাকয়ে একলে, না শুনে কাহারো কথা। সদাই ধেয়ানে, চাহে মেঘ-পানে, না চলে নয়ান-তারা। বিরতি আহারে রাঙাবাস পরে, যেমত যোগিনী-পারা।”
তিনরাত জগন্নাথ খোলা আকাশের নিচে মন্দিরের বাইরে কাটায়। তিনরাত জগন্নাথ লক্ষ্মী বিহনে কাটান। অভিমান করে তিন দিন মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। তিন দিনের শাস্তি। দূরে কোথাও কোন ভবিষ্যতের যুগে গান বাজছে, সজনী গো সজনী দিন রজনী কাটে না!
বিহনেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি গান লেখা হয়। কবিতা লেখা হয়। কত যে গানের কলি মাথায় আসে। হয়তো জগন্নাথ লক্ষ্মীও গুনগুণ করে এগুলোই গাইছেন। হয়তো অস্ফুটে বলা, “কাটেনা প্রহর তোমার বিহনে একা একা নিরালায়, কত যে দিন কত যে রাত পথ চেয়ে থাকি আশায়!”
জগন্নাথ জগতের নাথ। মুখের উপর দরজা সপাটে বন্ধ হতেই চলে যেতে পারতেন। চাইলেই অন্য কোন ঘরে বিশ্রাম নিতে পারতেন। যান নি। আসলে চলে যাওয়াটা সহজ। শত ভুলের পরেও সেগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে, আবার ফেল করে আবার ফিরে আসার নাম, থেকে যাওয়ার নামই সম্পর্ক। Short absences quicken love। বিহনে প্রেম বাড়ে। একটুকু ছোঁয়া, একটুকু কথা ও তার অনুরণন নিয়ে দিনরাত এক করে দেওয়া।
তিনদিন ধরে জগন্নাথের আকুতি মিনতি শেষে লক্ষ্মী দেবী চাহনি মন্ডপে এসে উপস্থিত হন। এখানেও হয়তো আমাদের চারপাশের লক্ষ্মীদের ফিসফিস করে বলতে, সব রাগের একটা শেষ থাকে। মাত্রাবোধ থাকে। নারী মস্তিষ্ক বেজায় জটিল। কোথায়, কতদিন পরে গলে জল হয়ে যাবেন তারা এটা তারাই জানেন কিন্তু জগন্নাথরা এটুকু শুধু জানেন মানভঞ্জন হবেই। শুধু ধৈর্য ধরে থাকা। শুধু গেয়ে যাওয়া- “সাড়া দাও, সাড়া দাও, সাড়া দাও। উদাসীন থেকো না, সাড়া দাও।”
চাহনি মন্ডপ থেকে জগন্নাথের গোল্লা গোল্লা ছলছল চোখ দেখতে পেয়ে লক্ষ্মী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তারপর? তারপর সেই যুগেও দিল কো যব খুশি ছুঁ যায়ে, কুছ মিঠা হো যায়ে! আনা হলো সেই দেবভোগ্য মিষ্টান্ন।জগন্নাথের চোখের মতোই গোল্লা গোল্লা গোল্লা গোল্লা- রসগোল্লা। হাড়ি হাড়ি রসগোল্লা খেয়ে ও খাইয়ে দুজনে ফিরলো শেষে ঘর। বাইরে রেখে এলো কত না গভীর অর্থযুক্ত এক হাঁড়ি জগতের গল্প! জয় জগন্নাথ।
No comments:
Post a Comment