Tuesday, July 8, 2025

পবিত্র আশুরা। মুসলমানদের আশুরা, হুসাইনি ব্রাহ্মণদের আশুরা।

নিজস্ব প্রতিবেদক:
এই পৃথিবীর এক অদ্ভুত সত্য হচ্ছে— এই পৃথিবীতে কিছু গল্প ইতিহাস হয়ে যায়, আর কিছু ইতিহাস রূপকথার মত শোনায়।
হুসাইনি ব্রাহ্মণদের ইতিহাস তেমনই এক বিস্ময়কর অধ্যায় যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি ও আত্মত্যাগ এক অপূর্ব মানবিক বন্ধনে মিলিত হয়েছে। অনেকেই হয়তো জানেন না, কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইনের পাশে দাঁড়িয়ে হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ জাতির একটি উপশাখা নিজেদের পরিচয় অমর করে রেখেছে একটি ইসলামী মহান যুদ্ধের অংশীদার হিসেবে। আর ইতিহাসের এমন বিরল সংমিশ্রণ আমাদের শিখিয়েছে মানবতা ধর্মের সীমানা মানে না।

ইতিহাসে এই ব্রাহ্মণরাই "হুসাইনি ব্রাহ্মণ" হিসেবে পরিচিত। 

ঐতিহাসিক ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের মোহররম মাস। বর্তমান ইরাকের ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার নেতৃত্বাধীন উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন ইমাম হুসাইন। শাসকের অন্যায় ও ধর্মদ্রোহিতার প্রতিবাদে একটি শান্তিপূর্ণ অথচ প্রতিরোধমূলক অবস্থান নিয়ে ইমাম হুসাইন পরিবারসহ কারবালায় অবস্থান করছিলেন। তার সঙ্গে ছিলো তার পরিবার, কিছু বিশ্বস্ত সাহাবি, এবং এমন কিছু ব্যক্তি, যারা ধর্ম, জাতি বা ভূখণ্ডের বাইরেও সত্য ও ন্যায়ের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। আর এখানেই ঘটে ইতিহাসের অন্যতম অবিশ্বাস্য ও অসাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ। এই ইতিহাসে যোগ হয় রাহাব সিধ দত্ত বা রাহিব দত্তের নেতৃত্বে ভারত থেকে আগত একদল ব্রাহ্মণ যোদ্ধার। কথিত আছে, রাহিব দত্ত ও তার সাত পূত্র কারবালায় ইমাম হুসাইনের পক্ষে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। 

মৌখিক ইতিহাস, পারিবারিক উপাখ্যান এবং কিছু সুফি চিত্রকল্পে এই ঘটনার উপস্থিতি পাওয়া যায়। হুসাইনি ব্রাহ্মণদের বিশ্বাস, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা শুধু এক ধর্মীয় সংগ্রামে অংশ নেননি তাঁরা মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর শপথও নিয়েছিলেন।

হুসাইনি ব্রাহ্মণরা আদতে মোহিয়াল ব্রাহ্মণদের অংশ। মোহিয়াল শব্দটি এসেছে 'মহা-যোদ্ধা' থেকে। এই ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষত পাঞ্জাব ও কাশ্মীরে, বহু শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে। মোহিয়ালরা ধর্মীয় দীক্ষা ছাড়াও রণশিল্পে পারদর্শী ছিলেন।
এই মোহিয়াল ব্রাহ্মণদের আবার সাতটি শাখা। 
দত্ত (Dutt)
চিবার (Chhibber)
ভিমওয়াল (Bhimwal)
লাউ (Lau)
বৈদ (Vaid)
মল্ল (Mohan) এবং 
মোহন (Bali)

এদের মধ্যে দত্তরা সর্বাধিক পরিচিত। এবং হুসাইনি ব্রাহ্মণদের মূল উপশ্রেণিও এই "দত্ত ব্রাহ্মণ" রাই। তাঁরা মূলত নিজেদের রাজা দশরথের সন্তান পুত্র শ্রুতি কর্মা, কিংবা অনেকে নিজেদের শ্রী রামের পুরুষানুগত বলেও দাবী করেন। আর তাদের এই গৌরবোজ্জ্বল বংশপরিচয় শুরু থেকেই তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও বীরত্বের সংস্কার গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, হুসাইনি ব্রাহ্মণরা দ্বৈত ধর্মীয় পরিচয় বহন করেন। তারা হিন্দু ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা যেমন মানেন, ঠিক তেমনই ইমাম হুসাইনের শহীদিকে শ্রদ্ধা জানাতে মুসলিম রীতিতে মহররমও পালন করেন। কিছু পরিবার মহররম এর প্রথম দশ দিন নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন, অনেকেই তাজিয়া বানান ও মিছিলেও অংশ নেন।

তাদের এই রেওয়াজে মিল পাওয়া যায় সুফি ও হিন্দু আধ্যাত্মিকতার। শ্রীমদ্ভগবদগীতা ও কোরআন, দুই গ্রন্থের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে চলে অনেক পরিবার। প্রাচীন আমলের মিথ অনুযায়ী— "Wah Datt Sultan – Hindu ka dharm, Musalman ka iman, Adha Hindu, adha Musalman!"

এই প্রবাদ কিন্তু হুসাইনি ব্রাহ্মণদের পরিচয়ের দ্বৈততা নয়, বরং একটি যুগপৎ ধর্মীয় ও মানবিক আত্মিকতার প্রতীক।

যাই হোক, কারবালায় ফিরি।

কারবালার যুদ্ধ থেকে যারা বেঁচে ফিরেছিলেন, তাঁদের কিছু অংশ ভারতে ফিরে আসেন। মূলত পাঞ্জাব, হিমাচল, কাশ্মীর এবং উত্তর প্রদেশের কিছু অঞ্চলে তাঁরা বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলে অমৃতসর, দিল্লি, কাবুল এবং এমনকি লাহোর ও করাচিতেও তাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

অমৃতসর শহরে 'মাই কারমুন দত্তানি' নামের এক নারী বিচারপ্রধান হিসেবে কাজ করতেন বলে লোককথা আছে। এই নারী ছিলেন একজন সমাজনেত্রী, যিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা করতেন। এই দত্তদের সামাজিক অবস্থান ছিল বেশ উচ্চ। তাঁরা শিক্ষা, প্রশাসন ও সামরিক ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

কালের গহ্বর পেড়িয়ে এসে বর্তমান সময়ে হুসাইনি ব্রাহ্মণদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। একদিকে আধুনিকীকরণ, অন্যদিকে ধর্মীয় সংকীর্ণতা তাঁদের আত্মপরিচয়ে দ্বিধা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর বহু হুসাইনি ব্রাহ্মণ উদ্বাস্তু হন এবং তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে থাকে।

বর্তমানে দিল্লি, মুম্বাই, অমৃতসর, কানপুর ও পুনেতে কিছু পরিবার এই ঐতিহ্য লালন করেন। তাদের সন্তানরা এই ইতিহাস জানলেও অনেক সময় ধর্মীয় বিভাজনের ভয়ে তা প্রকাশ্যে প্রচারও করেন না।

তবুও ঐতিহ্য ধরে কিছু পরিবার এখনো মহররমে জুলুসে অংশ নেন, 'নওহা' ও 'মার্সিয়া' পাঠ করেন এবং প্রতিবছর কারবালার শহীদদের স্মরণে উপবাস রাখেন।

অনেকে জানলে অবাক হবেন যে, বলিউডের কিংবদন্তি অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত, তার পিতা সুনীল দত্ত কিন্তু এই হুসাইনি ব্রাহ্মণদের বংশধর! তার পরিবার মহররম পালন করত এবং ইমাম হুসাইনের স্মরণে তাজিয়া দান করত। বহু সাক্ষাৎকারে তিনি এই ঐতিহ্যকে গর্বের সাথে স্মরণ করেছেন।

আজকের পৃথিবী যখন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রতা এবং সামাজিক বিভাজনে জর্জরিত, তখন হুসাইনি ব্রাহ্মণদের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, একটি মানুষ তার ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে কেবল মানবতার পক্ষেও দাঁড়াতে পারে।

ইমাম হুসাইনের পক্ষে দাঁড়ানো মানে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এক হিন্দু যোদ্ধার তার জন্য প্রাণ দেয়া এই ইতিহাসের অলৌকিকতা নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের চিরন্তন আবেদন। সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা একটি সমাজকে কতখানি স্থিতিশীল ও উদার করতে পারে, তার অন্যতম শিক্ষাও এই "হুসাইনি ব্রাহ্মণদের" কীর্তিগাথা। হুসাইনি ব্রাহ্মণরা কন্তু ইতিহাসে শুধু একটি জাতিগোষ্ঠী নয়— তারা এক আদর্শ, এক বার্তা— “মানবতাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ ধর্ম।”

আসলে হুসাইনি ব্রাহ্মণদের ইতিহাস এক বিস্ময়কর সংমিশ্রণ। যেখানে ধর্ম, আত্মত্যাগ, সহানুভূতি এবং মানবিকতায় পূর্ণ এক গল্প গাঁথা হয়েছে। আজ যখন ধর্মীয় বিভাজন আমাদের সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করছে, তখন এই ইতিহাস আমাদের শেখায়, সত্যের জন্য সংগ্রামে ধর্ম নয়, মনুষ্যত্বই প্রধান।

ইতিহাস কিন্তু শুধু অতীত নয়, এটা কিন্তু ভবিষ্যতেরও প্রতিচ্ছবি। হুসাইনি ব্রাহ্মণদের ইতিহাস আমাদের শেখায়, মানবতা ও সহমর্মিতা সব ধর্মের ঊর্ধ্বে। তাদের বংশধররা হয়তো সংখ্যায় অল্প, কিন্তু তাদের ইতিহাস যেমন শিক্ষণীয়, তেমনই এটি মহাকাব্যের মতোই বিস্ময়কর; গর্বের।

লেখাটি তৈরি করেছেন স্নেহাস্পদ প্রসেনজিৎ রায় 

তথ্যসূত্র:
1. উইকিপিডিয়া 
2. .P. Russell Stracey, "History of the Mohyals" (1911)
3. Sisir Kumar Mitra, "The Vision of India" (1905)
4. Mohyal Sabha publications (Delhi Chapter Archives)
5. গুগল
6. চ্যাটজিপিটি

No comments:

Post a Comment

সাড়া দাও, সাড়া দাও, সাড়া দাও ।। ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

জগন্নাথদেব মাসির বাড়ি থেকে ফিরে সিংহ দুয়ার দিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবে আর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন মা লক্ষ্মী। মারাত্মক অভিমান। কোন অনুনয়...

Popular Post